Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

Title
Life story of Jayita Kamali Ravi Das
Image
Attachments

কমলী রবিদাশ

স্বামী- মৃত শিবনারায়ন রবিদাশ

মাতা- কিশোরী রবিদাশ

গ্রাম- কানিহাটি চা বাগান, ডাকঘর- শমশেরনগর, উপজেলা- কমলগঞ্জ, জেলা- মৌলভীবাজার।

-: আমার জীবনের করুন কাহিনী (জীবনবৃত্তান্ত) :-

এক চা শ্রমিক পরিবারে আমার জন্ম। তাই আমিও গতানুগতিভাবেই একজন চা শ্রমিক। অবহেলিত, অভুক্ত, নিষ্পেষিত, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত, ছোট ব্যাসের এক নির্ধারিত জীবনে বন্দিনী হয়েই শিশু, শৈশব, কৈশোরকাল একই নিয়মে একই বৃত্তে অতিবাহিত করি। চারিদিকে শুধুই অন্ধকার। শারীরিক অন্ধকার। মানসিক অন্ধকার। শু্ধুই শুন্যতা। শুধুই অভাব। একদিন বয়স না হওয়ার আগেই বয়সি হয়েছি বলেই মা-বাবার বোঝা কমানোর প্রয়াসে আমকে আরেক চা শ্রমিকের নাই নাই জীবনে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তাইনে (স্বামী) বাংলোর বাবুর্চি আছিল। অসুখ হইতে হইতে বিছানায় থাকিয়া থাকিয়া মরিয়া গেল মানুষ (স্বামী)। শাদির দুইতিন বছর পর থেকে বাগানে নাম (বাগানের কাজে যোগদান) লেখাইছি। ১৮ টাকায় নাম (কাজ) দিসে বাবু।

বাচ্চা তখন পেটে। তখন স্বামী ও ভালো ব্যবহার করতো না, কতদিন খুন্তি দিয়ে পিটাইসে, সবসময় ঝগড়া লাগাইতো। এ সময়ে মনে হতো ফাসি লাগিয়ে মরে যাই, পরে চিন্তা করতাম যে আমার পেটে তো আমার বাচ্চা, তারে যদি ভালোভাবে পড়াই-লিখাই তাইলে একদিন আমার নাম করবে ছেলে। তখন বাপের বাড়ি যে যাইতাম, এই টাকা ও ছিলো না। এইদিকে স্বামীর প্রতিদিনের মার সহ্য করার অবস্থাও ছিলো না। আমাদের ডাক্টারনি দিদির সাথে দেখা করি। এই সময়ে আমি আমাদের বাগানের ডাক্টারনির কাছে গেলে, তিনি আমাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে আমার মায়ের বাড়িতে (শ্রীমঙ্গল) পাঠিয়ে দেন। সেখানেই সন্তোষের জন্ম হয়। ভালা খাইতে পারমু কই? ভালা ভালা তো খাইতে পারছিলাম না তখন। দুধও হয় না। জনম থাকি বাচ্চার কষ্ট। তখন সাগুরে পানি দিয়া দুধের মতন করিয়া গুড় মিশাইয়া খাওয়াইতাম। এইটা খাইলে কী আর বাচ্চা পেট ভরে। বাচ্চার লাগিয়া তিন মাস ছুটি পাইছিলাম। তিন মাস পর থেকে তারে লইয়া কাজে যাইতাম। বাচ্চা লইয়া তখন নার্সারিতে কাজ করিতে দিত। চার মাস পর থেকে পটের দুধ দিয়া অন্যের কাছে রাখিয়া কাজে চলিয়া যাইতাম। মনটা পড়িয়া থাকিত বাচ্চার কাছে। সর্দাররে যাই যাই কইতাম। সর্দার বাচ্চাওলা মারে আগে আগে ছাড়িয়া দিত।

কষ্ট করিয়া করিয়া জীবন যাইতেছে আমার। খাইতে বসিলে ভাত সব খাইতে ইচ্ছা করিত না। কিন্তু বেশি ভাত নেওয়ার আগে চিন্তায় পড়িয়া যাইতাম, আইজকে ভাত বেশি খাইলে কাইলকে আমি কী খামু? পয়সাও (টাকা) তো নাই যে কিনিয়া খামু। মাছ-মাংস থোড়া থোড়া খাইতে চাইতাম, পারিতাম না তখন। কষ্টের কথা কিতা কমু। ভাবতে আমার দুঃখ লাগে। ভাবিয়া কইতে পারি না। আমার ছেলের বয়স যখন ০৬ মাস তখন তাইনে (স্বামী) মারা যায়। মারা যাওয়ার যাওয়ার পর থেকে আরেক কষ্টের জীবন শুরু হইছে। যে পর্যন্ত মাটিতে না যাইবো সে পর্যন্ত আমার দুঃখ যাইবো না।

চাতলাপুর চেকপোস্ট এর দিকে আমতলীর আগে একটা বাজার আছে, আমার বাপ দাদার জনমে কখনো সেদিকে যাইনাই। কিন্তু বাচ্চার লাগি যাইতে অইছে। অনেকের কাছে ধার চাইছি। কেউ দিবার চায় নাই। কইছে বেটি কাজ করিয়া খায়। পয়সা নিলে ক্যামনে দিবো। তাই মাটি পর্যন্ত তুলতে হইছে। বেটারা মাটি কাটিয়া মাথায় তুলিয়া দিত। আমরা নিয়া মোকামের ভিটা ভরাট করিতাম। ২০০-৩০০ টাকা পাইতাম। সকালে সাতটায় যাইতাম। আইতে আইতে সোয়া পাঁচটা বাজিয়া যাইতো। এই পইসা জমাইয়া যখন ছেলেকে দিতাম তখন মনে ভালো লাগিতো। ভাবিতাম যে ছেলে মোর ভালো আছে। বালুও তুলছি আরেক জায়গায়। বালুর কাম শেষ করিয়া আইতে আইতে সাত আট টা বাজিয়া যাইতো।অনেক সময় ঠিকাদারে টেকা পইসসা মারিয়া দিত,তখন যে কষ্ট লাগিত, বুঝাইবার পারিব না।

ঘরে আসিয়া কান্দিয়া কান্দিয়া আটার রুটি বানাইতাম রাইতে। রুটি গুলা পলিথিনে ভরে গামছায় প্যাচাইয়া তুলিয়া রাখিতাম সকালের জন্য। আর বাচ্চার লাগি অল্প করিয়া ভাত রান্ধিতাম। বাচ্চা কইতো, ওমা ভাত খাওনা কিসের লাগি? কইতাম, ভাত খাইতে আমার মন চায় নারে বাপ। আমি আটার রুটি খামু!

কাপড় জায়গায় জায়গায় ছিড়িয়া পরার উপায় থাকতো না। জোড়াতালি দিয়া কোনমতে প্যাচাইয়া পরিতাম। কিন্তু বেশিদিন হইলে কাপড় নরম হইয়া ছিড়িয়া যাইতো। বাবুদের সামনে যাইতে শরম করিত। কাজের শেষে ছড়ায় গেছি স্নান করতে। ভিজা কাপড়টা প্যাচানোর সময় ছিড়িয়া গেল। দেখিয়া এক দিদি কইলো, এমন ছিড়া কাপড় কিতার লাগি পিনছো দিদি? কি যে শরম পাইছিলাম। পরে সেই দিদি ম্যালা জোর করিয়া আমারে একটা কাপড়, একটা ছায়া আর একটা বেলাজ (ব্লাউজ) দিয়া দিল। সেই কাপড় লইয়া ঘরে ফিইরা অনেক কানছি।

কাজের ফাকে কয়েকজন মিলিয়া খাইতে বসি। বাগানে আমরা ভর্তা লইয়া যাইতাম। তোরা নাই বুঝবি, তোরা হাসবি এইগুলান শুনে। হামরা কাচা পাতা হাত মলা করে, আলু সিদ্ধ করে, চানাচুর, মরিচ ভাজিয়া বানাইতাম পাত্তিচোখা (পাতিসানা)। কিন্তু মরিচের লাগি সবদিন সবাই ভর্তা নিতে পারতো না। খাইতে বইলে একজন আরেকজনরে জিগাইতাম, দিদি তুমি নিছনি? কইতাম আইজকা আমি আনছি। পরে থোড়া থোড়া দিতাম।

অসুখ হইলে বাবুরে কইয়া সিক নিতাম। কিন্তু বাবু বিশ্বাস রাখতে চাইতো না। বেশি অসুস্থ না হইলে নিজেরাও অনেক সময় সিক নিতে চাইতাম না। কারণ সিক বাকি থাকলে একদিন না একদিন কাজে আইবো। দুই তিন সিক হইলে পরে ছুটি বহাইয়া দিত। ছুটি বহাইলে তো মজুরি বাতিল। এই কারণে বেশি অসুখ না অইলে সিক নিতে চাইতো না কেউ।

২০০৭ সালের আমার ছেলে যখন ক্লাব ফাইভে পড়ে। তখন আমার মজুরি ৮৮ টাকা। একদিন সকালের ঘরে খাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। ছেলেকে বললাম আজ স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। হেটে হেটে বাজারে যা। ৫ কেজি সরকারি চাল ৬০ টাকায় নিয়ে আয়। সেই কষ্ট, সেই অবুঝ ছেলের ঘাড়ে বোঝা তুলে দেওয়ার, সেই মোটা চালের কথা ভুলতে পারিনি এখনো।

আমার তখনকার জীবনে প্রতিদিন সকালে চাল ভাজতাম আর কৃপনের মতো ছোট ছোট করে রুটি বানাতাম। সেই ভাজা চাল, পোকা ধারা আটার গুনে গুনে ১টা রুটি, লাল চা একটা বোতলে ভরে, প্লাস্টিকের পলিতে করে নিজের চা পাতা তোলার গামছাতে ভরতাম। তারপর ছেলেকে ১টা আটার রুটি এবং লাল চা দিতাম। নিজেও ০১টা রুটি নিয়ে চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে আমরা সকালের নাস্তা করতাম। দুপুরে ছেলের জন্য যা রেখে যেতাম তা সারাটা দিন আমার বুকে সেলের মতো বিধত। ছেলে আমার ছোট একটা পিয়াজের অর্ধেক দিয়ে, শুকনো ভাত, তেল আর লবন মাখিয়ে খেত। রাতের জন্য প্রায়দিনই কোনো তরকারি আনার ক্ষমতা আমার ছিলো না। তখন ঘরে যা থাকত তা খেয়েই মা আর ছেলে ঘুমিয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে পাশের বাসার লোকজন আমার ছেলেকে ডেকে নিয়ে তাদের নাই নাই সংসার থেকে একটু তরকারি দিত। এখনো মনে পড়ে কখনে কখনো আমরা লোকজনের দেওয়া তরকারি দিয়ে দুই তিন দিন পার করেছিলাম।

তারপর ২০০৭ সালেই আমার ছেলে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে ৫ বছরের জন্যে ফ্রী তে পড়ালেখার জন্য সুযোগ পায়। এতে অশিক্ষিত হয়েও কতটা খুশি হয়েছিলাম তা শুধু আমি জানি। সেই সময় ছেলের হোস্টেলের ছুটি হইলে আমার ছেলের যেন কোন কষ্ট না হয় সেজন্য আমি নিজের কান্ধে করে তার ব্যাগ নিয়ে অনেকটা পথ হেটে তাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে কখনো প্রচন্ড রোদে পোড়ে, কখনো বৃষ্টিতে ভিজে আবার হেটে হেটেই বাড়ি ফিরতাম। ছিল না একটা ছাতা কিনার সাধ্য।

জীবনের সেই বহমান সময়ে আমার সামান্য আয়ের একটা অংশ থেকে তাকে যতটা প্রয়োজন ততটা দেওয়ার চেষ্টা করে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হতে বাধ্য হই। এসবের মাঝেও তার টিফিন খাওয়ার জন্য প্রত্যেক সপ্তাহে ১০০/৮০ টাকা দিতাম যাতে সে তার পকেট খরচ ও টিফিন খেতে পারে। তখন এইদিকে আমি একাই বাড়িতে থাকতাম আর সবকিছু নিজেই দেখাশোনা করতাম। এই জীবন যোদ্ধ দেখার মতো কেউ ছিল না আমার। নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হত। প্রচন্ড অসুখ বিসুখের সময় একফোটা পানি দেবে- এমন কেউও ছিলা না। তবে তখন একটা স্বপ্ন ছিল মনের গহীন কোণে- ছেলে আমার একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে।

২০১৩ সালে সে বি এ এফ শাহীন কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তখন আমার কাজের হাজিরা ছিলো ১০২ টাকা। এই সময়ে আমি ছেলের লেখাপড়ার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে কিস্তি তুলে আমার ভর্তি, কলেজের ড্রেস আর বই খাতা কিনে দেই। আমার ইনকাম দিয়ে আমার আর চালিয়ে যেতে পারছিলাম না দেখে ছেলে আমার তখন টিউশনি শুরু করে। সেই টিউশনির টাকা দিয়ে সে কলেজের ১০২০ টাকা মাসিক বেতন নিজেই দিত। ছেলেকে নিয়ে আমার স্বপ্ন তখন আরো বড় হতে লাগলো। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল।

সেই সময়ে ছেলের টিফিনের টাকা দেওয়ার সামর্থ হারিয়ে ফেলি। ঋণের কিস্তি, ছেলের যাবতিয় খরচ, নিজের খাওয়ার খরচ মিলিয়ে আমি খেই হারিয়ে ফেলি। তাই বাধ্য হয়ে বাসা থেকেই রুটি, তরকারি টিফিন হিসাবে তার কলেজ ব্যাগে ভরে দিতাম। আমার ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। আমার জীবনের মতোই ঘরটাও অন্ধকার ছিল। কুপি বাতি দিয়ে আমার ছেলে লেখাপড়া করতো। তার লেখাপড়ায় যাতে কোন ঘাটতি না হয় সে জন্য আমি আগে থেকেই সব রেডি করে রাখতাম। কিন্তু কুপির তেল শেষ হয়ে গেলে কিনে আনার সামর্থ থাকত না। দোকান থেকে বাকিও দিত না। ছেলের লেখাপড়া রাতের অন্ধকারের নিকষ কালোতেই থমকে যেত।

সালটা ২০১৪ এর ডিসেম্বর। আমার হাতে কোন টাকা নেই। বোর্ড পরীক্ষার জন্য সেই সময়ে শাহীন কলেজের রেজিষ্ট্রেশন শুরু হয়। আমি হাজার চেষ্টা করেও কোন টাকা জোগাড় করতে পারিনি। বুকে পাথর চাপা কষ্ট আর চোখে এক সমুদ্র জল নিয়ে একজন ব্যর্থ মা হয়ে ছেলে সামনে একটা ৫০টাকার একটা নোট এগিয়ে দেই। ছেলে আমার কষ্ট বুঝে। সেও কেদে কেদে এই ৫০ টাকা নিয়ে নেয়। তারপর কিভাবে যেন ঈশ্বর সবকিছু মিলিয়ে দেন। রেজিষ্ট্রেশনের টাকাটা তার একজন শিক্ষকের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে সে পেয়ে যায়। সেই ধার করা টাকা দিয়েই তার রেজিষ্ট্রেশন হয়।

তারপর ২০১৫ সালের মে মাসে সে ভার্সিটি কোচিং এর জন্যে সিলেট যায়। ভার্সিটি কোচিং এর ফি, থাকা খাওয়া এর জন্যে আমি ২৫০০০টাকা লোন নেই গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে। এই টাকা দিয়েই এডমিশন টেষ্ট এর কোচিং যাত্রা শুরু হয়। এই সময় আমি  বালু শ্রমিক হিসাবে বালু তুলতে যেতাম। বিনিময়ে পেতাম ৩০০ টাকা। এই সময়টাতে কোন দিন শুধু আলু ভাত খেয়ে আবার কোন দিন ইচ্ছা করেই না খেয়ে পার করতাম। না খেয়ে টাকা বাচিয়ে সেই টাকা দিয়ে সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতাম।

ভার্সিটি কোচিং চলাকালে সে বাসায় আসলে আমার এই কষ্ট দেখে সে কেদে কেদে বুক ভাসাত। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বলতাম- তোমার ভবিষ্যতের জন্যে আমি নিজের জীবনের মায়া ছেড়ে অনেক দূরে গিয়ে বালু শ্রমিক হিসাবে কাজ করছি- এটা তো তুচ্ছ। তবে তোমার কাছে আমার প্রত্যাশা শুধু এটাই- তোমাকে থামলে চলবে না। তোমাকে নিজের পথে এগিয়ে যেতেই হবে। তোমাকে পারতেই হবে। আর হয়তো এই কথাগুলোই ছিলো আমার ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার মূল চাবি।

এই সময়ে, তার যখন টাকা প্রয়োজন হতো তখন আমি বিভিন্ন যায়গা থেকে লোন, ধার, করজা করে তাকে বিকাশে পাঠিয়ে দিতাম। পরে সেই টাকা মাঝে মাঝে সময় মতো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হতাম। লাঞ্চিত, বঞ্চিত হতাম। কত খারাপ খারাপ কথা শুনতাম। তবে সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা ছিল- সেই সময় অনেকে টাকা থাকা স্বত্তেও আমি টাকা পরিশোধ করতে পারব না ভেবে আমাকে টাকা ধার হিসাবে দেয়নি।

তবে আমার ছেলে যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য সুযোগ পায় তখন আমার জীবনের শুণ্যতা যেন পূর্ণ হয়ে যায়। মনে হয় জীবনে কখনো কোন দুঃখে ছিলাম না। ছিলাম না কোন অন্ধকারে। কিন্তু বাস্তবতা কি ছিল আমি জানি। আমার ছেলে জানে।

যখন ডিসি স্যার এলাকায় এসে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে আমার এই সংগ্রামের  প্রশংসা করলেন তখন আমি মা হওয়ার স্বার্থকতা আমি অনুভব করলাম।

ছেলের এডমিশন এর সময়েও আমি কোনো টাকা দিতে পারেননি। আমাদের সমাজের লোক, বিত্তবান ব্যক্তি, সংগঠন আমাকে সাথে নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে চান্দা তুলে টাকা দিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করায়। এই সব মানুষের কাছে আমি চিরঋণী, চির কৃতজ্ঞ। তারা এগিয়ে না এলে অর্থাভাবে হয়তো আমার ছেলের এডমিশন নেওয়াই হতো না। হতো না আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

ভার্সিটির খরচ জোগানো আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। তাই সে টিউশনি করিয়ে টাকা যোগাড় করত। আমি তখন আমার মজুরি থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে ৩০০/৪০০ টাকা তাকে দিতাম- যা দিয়ে সে মনিরের ক্যানটিনে ২০ টাকার সবজি ভাত খেয়েই রাত কাটাতে বাধ্য হতো। সকালে তার কাছে নাস্তার জন্য কোনো টাকা থাকতো না। অভুক্ত থাকতো ছেলে আমার। দুর্গা পুজার আগে কখনো আমরা একটা জামা কিনতে পারিনি। তাই ভার্সিটিতে উঠার পরেও আমি আমার ছেলেকে কোনো জামা কিনে দিতে পারেননি।

২০১৮ সালের দিকে যখন শ্রেষ্ঠ মা হিসাবে উপজেলায় মাদের সসম্মাননা দিবে বলে ইউনিয়ন পরিষদের লোকজন জানান। তবে উনারা পরে তালিকা থেকে আমার নামটা কেটে দেন। তার মনে করে যে, বাগানী বেটি, চা-শ্রমিক, সে বক্তব্য দিতে পারবেনা। এই তিক্ততা আমাকে এখনো অনেক ব্যথা দেয়।

আমার পৃথিবী আমার ছেলে কেন্দ্রিক ছিল। নিজে অশিক্ষিত ছিলাম বলে লেখাপড়ার ধারা বুঝতাম না। তবে আমি থেমে থাকিনি। ছেলের কাছে পই পই করে জিজ্ঞাস করে বুঝার চেষ্টা করতাম। এভাবেই আমি আমার ছেলের পরবর্তী গন্তব্যর ধারাটা জানলাম। এবং এম বি এর ভর্তির টাকা আগেই জোগাড় করে রাখলাম। পরে মাস্টার্স করতেও তার কোন সমস্যা হয়নি।

এই জীবনে বেচে থাকাটা কতটা ভয়াবহ তা একমাত্র আমার মতো মানুষই বুঝবে। আর যারা আমাদের মতো মানুষকে মানুষের চোখে দেখে- তারাও এটা অনুভব করবে।  

সপ্তাহের কোন দিন যদি আমি একটু বেশি পাতা তুলতে পারতাম। সেই অতিরিক্ত পাতা হিসাব করে বুধবারে নির্দিষ্ট তলবের চেয়ে একটু বেশি তলব পেতাম। সেই অল্প তলবকে কোটি টাকা মনে হতো। গত হয়ে যাওয়া ছেলের অভুক্ত রাতগুলো ফিরিয়ে দিতে চেষ্ট করতাম। কিন্ত পরদিন রাত থেকেই আগের রাতগুলোই ফিরে আসতো।

জীবনের এ প্রান্তে এসে বয়সের ছাপ পড়েছে শরীর ও মনে। ভাবি কবে যে কাজ থেকে রিটায়ার্ড হব। শরীর নামের কাঠামোটা সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কাজে যেতে মন চায় না তবুও সংসারের জন্যে যেতে হয়। শরীরে নানা রোগ বাসা বাধতে শুরু করেছে। তবে এখন প্রশান্তির এক মিষ্টি হাওয়া বহে যায় আমার এই অশীতিপর শরীরে। সুখের এক অববাহিকা বহে যায় এই পোড় খাওয়া হৃদয়ে। ছেলে আমার বড় হয়েছে। মানুষ হয়েছে। আমার স্বপ্নকে স্বপ্ন থেকে জীবনের মাঝে নিয়ে এসে আমার মা হওয়াকে স্বার্থক করেছে।